আড্ডাবাজি

গ্রিক সভ্যতা যখন তার ঐশ্বর্য, মহিমা, বিশালতার মধ্যগগনে অবস্থান করছিলো, সেই যুগে বিখ্যাত দার্শনিক রেনে দেকার্তে প্রায় সাত মাইল পায়ে হেঁটে সক্রেটিসের বক্তব্য শুনতে আসতো। সক্রেটিসের কাছে এসে ছোট-বড়, ধনী-গরীবের ভেদাভেদ হাওয়ায় মিশিয়ে যেত। গ্রিসের রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যেত বেটপ, কালো উসকুখুসকু চুলের, অসুন্দর এক লোককে ঘিরে জটলা বেঁধেছে। রেনে দেকার্তের মত বহু মানুষ একটা কুৎসিত মানুষের ভাবশিষ্যে পরিনত হয়েছে সক্রেটিসের তীক্ষ্নবুদ্ধি ও যৌক্তিক চিন্তার স্ফুরনের কারনে । নগর সভ্যতার দোর্দন্ড প্রতাপের সেই যুগে সক্রেটিস জটলা বাধিয়ে, দাঁড়িয়ে, বসে, হাত নাড়িয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ আড্ডাগুলো দিতেন । তার কথা, বাণী, যুক্তির ক্ষুরদার বিতর্ক সবার মধ্যে দ্রোহের প্রতিভাস তৈরি করতো । মনে হতো সক্রেটিস এই প্রথম এমন কথা বললো, এই প্রথম এমন সব তত্ত্বের অবতারণা করলো, যা পৃথিবীবাসী এর আগে এমন কথা কখনো শুনে নাই।!! সক্রেটিস মানুষকে শোনাতো বড় বড় সপ্নের কথা। আকাশসম মুক্তির কথা। জীবন দর্শনের বড় বড় ডিসকোর্সের কথা । তার মাথা থেকে নব নব চিন্তার এমন গলিত লাভা বের হতো যার সক্রিয় প্রবাহ এখনো বিদ্যমান। সক্রেটিস প্রচুর আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন । তিনি অলস সময় কাটাতে মাঝে মাঝে । অবসর সময়ের আলসেমীকে তিনি পরিণত করেছিলেন চিন্তা চর্চার কারখানা হিসেবে।

আমাদের জীবনে আড্ডা শব্দটি ক্রমশ বিলুপ্ত প্রায় একটি শব্দের নাম।
আড্ডা, গল্প, অবসর, আলসেমী ইত্যাদি শব্দগুলো এখন আমাদের কাছে দাগী আসামীর মত মনে হয় । আটটা-পাঁচটার ঘড়ি ধরে, ফিংগার প্রিন্টের ছাঁচে মুড়িয়ে, এক স্থবির যন্ত্রচালিত জীবনের পূজা করতে করতেই আমরা ক্লান্ত । আড্ডা বিহীন, বিনোদনবিহীন এক অনি:শ্বেষ যন্ত্রনার কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত হচ্ছি আমরা । কাজের ফাঁকে, পড়ার ফাঁকে, সংসারধর্মের চক্রাকার ঘানির ফাকে ফাকে যে নির্মল অবকাশের দরকার আছে, আমরা তা মানতে নারাজ।

বায়ুদুষন, শব্দদুষন, নৈতিকদুষনের কলংক মাথায় নিয়ে আমরা জীবনযুদ্ধের কুরুক্ষেত্রে শামিল হচ্ছি প্রতিনিয়ত । সেখান থেকে কি পাচ্ছি আমরা ?? যেটুকু ই বা পাচ্ছি হারাচ্ছি না কি তার থেকেও বেশী ??? উত্তর ই বা কে দিবে।
অথচ জীবনের বড় বড় চিন্তা, মহান আবিষ্কার ,সংগীত, কলা, কাব্য, সাহিত্য ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষকতার গোড়ায় রয়েছে এই আড্ডা। জগতের সমস্ত ভালো কিছু হয়েছে আড্ডাবাজিতে, আলসেমিতে ।
জীবনটাকে লেফট-রাইটের শিকলে ফেলে, আটটা-পাঁচটার ফিংগার প্রিন্টের ছাঁচে ফেলে কখনো বড় কিছু পাওয়া যায় না। মানুষের মননের গড়ন, প্রতিভার ধরনটাই এমন যে, তাকে নিয়ম-শৃংখলার পাটাতনে পিষে ফেললে তার মাথা থেকে মহৎ কোন চিন্তা, মহৎ কোন দৃষ্টিভংগী তৈরি হওয়া কঠিন । যে মানুষটা প্রতিদিন একই চিন্তা- ভাবনা ও কাজে ব্যস্ত থাকে সে নতুন কিছু চিন্তা করার সময় পাবে কই?

পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে মানুষের ঝোঁক ছিলো বিভিন্ন । কোন সময় মানুষ ছুটে চলেছে ধর্মের নেশায়। এক সময় হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে, মানব সন্তান ধর্মীয় চেতনার উন্নত আদর্শে দীক্ষীত হয়ে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
সনাতন,বৌদ্ধ-জুদাইজম-খ্রিস্ট-ইসলাম প্রভৃতি ধর্মের শ্রেষ্ঠবাণীগুলোকে মানুষ পেয়েছে গুরু-শিষ্যের আড্ডায়। এই ধর্মগুলো এসেছে সৃষ্টিকর্তার সাথে ধর্মগুরুর একান্ত নিভৃত ধ্যানের মাধ্যমে।

একটা সময় মানুষ সংগীত-সাহিত্যের নেশায় দৌড়ে বেড়িয়েছে। মহাভারত, ইলিয়াড,ওডিসি, ফাউস্ট, বেটোফেনের মত অমৃত প্রসাদময় সৃষ্টিগুলো পৃথিবীতে এসেছে কবি-লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পীদের প্রানবন্ত আড্ডায়। রাতভর মৃদুমন্দ খোশগল্পে । প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, হুমায়ন আহমেদ, আহমদ শরীফদের মত অগ্নিবর্ষীয়নরা তো আড্ডার সমুদ্রে অবগাহন করেই জাতির দিকদর্শনের প্রতিভূ হয়ে আছেন । সংগীত- সাহিত্যের মনবিমোহনী বর্ণচ্ছটা, প্রেমের বর্ণাঢ্য ঐশ্বর্য, সত্য ও সুন্দরের জোতির্ময় প্রকাশ সম্ভব হয়েছে মানুষের নিরুপদ্রব অবকাশে,তার নাতিদীর্ঘ আলসেমিতে আর হার্টথ্রব আড্ডাবাজির বৈঠকখানায়।

নিকট অতীতে মানুষ ছুটে চলছে প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের অসাধারন প্রসারণের নেশায় । অন্তরীক্ষের শেষ বিন্দু থেকে দূর নক্ষত্রের অন্তিম সীমা পর্যন্ত আজ প্রযুক্তি বিজ্ঞানের জয়জয়কার । আইনস্টাইন তার আপক্ষিক তত্ত্বের গানিতিক যুক্তিতে ধার দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ভায়োলিন বাজাতেন । বিজ্ঞানের এই যে লাগাম ছাড়া অগ্রগতি তার মুলেও রয়েছে এই আড্ডা-ভায়োলিনের নিরুংকুশ প্রেরনা । পারষ্পারিক মতবিনিময় আর তর্ক-বিতর্কের বাহাসের মধ্য দিয়েই প্রযুক্তি তার নতুন ঠিকানা খুঁজে পায় । এরই ধারাবাহিকতায় জগদ্বিখ্যাত বেল ল্যাব, সিলিকন ভ্যালি, অক্সফোর্ডের ক্রাইসটাস্ট কলেজে চলেছে চায়ের কাপের প্রজ্ঞামন্ডিত আড্ডাগুলো।

অতিসামপ্রতিক মানুষ ছুটে চলেছে এক ভয়ংকর নেশায়। এই নেশা ধর্ম, সংগীত, প্রযুক্তি বা সভ্যতা বিনির্মানের নেশা থেকে খুব ই আলাদা । এখন মানুষ ডুবে আছে বিত্ত-বৈভবের নেশায় । টাকার প্রয়োজনের দিকটা অস্বীকার করার উপায় নেই । এর প্রয়োজনীয় দিকটা খুবই মূল্যবান । আর টাকার অপ্রয়োজনীয় দিকটা তৈরি করে দ্বন্দ্ব। তৈরি করে স্বার্থ-সংঘাত। এ জন্যেই বলে অর্থই অনর্থের মূল । অতিরিক্ত বিত্ত-বৈভবের নেশা নিয়ে আসে অবিশ্বাস। অতিরিক্ত বিত্ত লালসা নিয়ে আসে চরম হতাশা । আর আমাদের কাছে আপাত অপ্রয়োজনীয় অথচ মুল্যবান সংগীত-কলা-স্থাপত্য-শিল্প জীবনকে করে তোলে মহৎ। এরা জীবনকে করে তোলে শ্রেষ্ঠ । শিল্পকলার বর্ণরন্জিত চোখে জীবনটা সত্যিই সুন্দর হয়ে উঠে ।

শিল্প-সংগীত-সাহিত্য-স্থাপত্য ছাড়া জীবন নিম্নমানের পোকামাকড়ের মতই বিষাদে ভরে উঠে । চীনের গর্ব তার গ্রেট ওয়ালে । ফরাসি জাতির গর্ব তার আইফেল টাওয়ার, লুভ্যর মিউজিয়ামে । রোমের গর্ব তার কলোসিয়াম আর ভারতের সম্মান তার তাজমহলে। এগুলো শুধু ইটপাথরে গড়া বস্তু মাত্রই নয় । এদের নান্দনিক মূল্য অপরিসীম ।

আকাশের নীলাভ মুখশ্রী, মেঘের সাদা ভেলা, বৃষ্টির দ্রিমী দ্রিমী নৃত্য, শিশিরের বর্ণিল বিন্দুচ্ছটা , কুয়াশার ধোঁয়া ওঠা হিম,পাহাড়ের সুউচ্চ গ্রীবা, সুরের সুগভীর বিহ্বলতা, চিত্র শিল্পের রুপকল্পময়তা, ধর্মের নৈসর্গিক আবাহন এই সবকিছু মানুষকে বড় করে তোলে। সমুদ্রের মত উদার করে তোলে । পর্বতের মত দৃঢ় করে তোলে । জীবন, জগৎ, প্রকৃতির বিশুদ্ধ মেলবন্ধন তৈরিতে এই অপ্রয়োজনীয় অথচ অতিমুল্যবান বিষয়গুলো আমাদের শ্রেষ্ঠ মানস সম্পদ । মানুষ একটু সময় পেলে, খানিক অবসর পেলে, একটু ঢিলেঢালা পরিবেশ পেলে সে তার আপন জগতের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ায় । সে নিজেকে চিনতে পারে নিজের মত করে । একটু অবসর পেলেই আপন প্রতিভার ঝাঁপি খুলে বসে সে । এমন কি আমরা বাথরুমে বসে যেটুকু সময় পাই সেই সময়েও গুনগুন করে গেয়ে উঠি । কারন ওই সময়ে আমরা বিরতিতে থাকি। ওই সময়ে নিজের জগতে থাকি। আমরা যখন বন্ধু মহলে আড্ডা দেই তখন সুযোগ পেলে নতুন নতুন যুগান্তকারী আইডিয়ার সংশ্লেষ ঘটাই। কারন তখন আমরা আড্ডাবাজির আতশবাজির মতই সতত জ্বলতে থাকি । আর এই সমস্ত বড় বড় চিন্তা, বড় বড় দৃষ্টিভংগী তৈরি হবে না, যদি আমরা শুধু টাকা কামানো অথবা বিত্ত-সম্পদের পিছনেই দোড়াতে থাকি।

মোট কথা হলো বাঁচবার জন্যে যতটুকু দরকার ততটুকুই দৌড়ানো । একঘেয়েমি জীবনে সময়ে-অসময়ে বিরতি দেওয়া দরকার। কখনো কখনো ইচ্ছে করেই ঘুম থেকে দেরিতে উঠা দরকার। কখনো কখনো চিরাচরিত রীতির জাল ছিন্ন করে নদীর ধারে বেড়ে উঠা কাশফুলের পিউলিন স্পর্শ নেওয়া উচিত। কখনো কখনো বা দুরের বনের ফাঁক গলে বেড়িয়ে আসা পূর্ণিমা চাঁদের বিলাসবহুল সৌন্দর্য উপভোগ করা উচিত । ক্ষণিকের দু:খ-কষ্ট,বঞ্চনা, আটটা- পাঁচ টার গ্লানি ভুলে মাঝে মাঝে জোছনা বিলাসে মগ্ন থাকা দরকার। দেখা যাবে জীবন তখন কত সুন্দর! কত মধুর!! আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে যত বেশি এক্টিভ বাস্তব জীবনে সে তত বেশি একা । জীবনের সুকুমার সৌন্দর্যগুলো শুধু মাত্র ফেসবুকের নীল পাতাতে আটকে থাকতে পারে না। ইথার তরংগের দম বন্ধ করা একাকিত্ব থেকে বেড়িয়ে এসে, সবাই এক হয়ে, যূথবদ্ধ হয়ে, এই টুইটুম্বর বর্ষায় কলাগাছের সোনালী ভেলাতে ভাসতে ভাসতে এক সময় আনন্দমুখর, প্রাণোচ্ছল আড্ডাবাজিতে যদি ডুবে যাই তাতে খুব বেশি ক্ষতি হবে কি ??????????????

মাসুদ রানা শাহীন

3 thoughts on “0

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Next Post

10 most famous person of Bangladesh

Sat Feb 11 , 2023
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, also known as Sheikh Mujib, was the founding father of Bangladesh and its first President. He was born on 17 March 1920 in Tungipara, a small village in Gopalganj district in Bangladesh. He was a charismatic leader and was known for his passionate speeches that inspired millions of Bangladeshis to fight […]
Next post 10 most famous person of Bangladesh